স্বদেশ ডেস্ক:
ভারতে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের এক বিচারিক আদালতের সাম্প্রতিক রায়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ ৩৬ বছর আগে মুসলিম গণহত্যার শিকার পরিবারগুলো। ওই গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ৪১ জন হিন্দু পুরুষকে খালাস দিয়েছে আদালত।
নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ১৯৮৭ সালের ২৩ মে মীরাট শহরের উপকণ্ঠে মালিয়ানা নামে এক গ্রামে। ওই দাঙ্গার ঘটনায় হত্যা করা হয় ৭২ জন মুসলিমকে। অভিযোগের তীর ছিল স্থানীয় হিন্দু এবং রাজ্যের সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর দিকে। ওই ঘটনাকে “ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য ন্যাক্কারজনক” বলে বর্ণনা করা হয়।
এখন সমালোচকরা বলছেন সেশন আদালতে শুক্রবারের এই রায় “বিচারের নামে প্রহসন”।
উত্তর প্রদেশ পুলিশের একজন সাবেক মহাপরিচালক বিভূতি নারায়ণ রাই একে ব্যাখ্যা করেছেন “রাজ্যের একটা চরম ব্যর্থতা” হিসেবে।
বিবিসিকে তিনি বলেছেন, “স্বার্থসংশ্লিষ্ট সবগুলো মহল, যেমন পুলিশ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, একপেশে সংবাদমাধ্যম এবং সবশেষে এখন আদালতও ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।”
‘ভুলে ভরা তদন্ত প্রক্রিয়া’
রাই, এবং তার সাথে ঊর্ধ্বতন একজন সাংবাদিক কুরবান আলি, যিনি ওই দাঙ্গার ঘটনা ব্যাপকভাবে রিপোর্ট করেছিলেন, এছাড়াও ওই গণহত্যা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুই ব্যক্তি এই মামলার যে মন্থর গতিতে চলছে তা নিয়ে অভিযোগ করে ২০২১ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টে একটি পিটিশন করেন।
“তদন্ত প্রক্রিয়া গোড়া থেকেই ছিল ভুলে ভরা। এই মামলাও গড়িয়ে গড়িয়ে চলছিল সাড়ে তিন দশক ধরে। কাজেই আমরা নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দেবার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেছিলাম। আবেদন করেছিলাম একটা ন্যায়বিচারের জন্য, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়,” জানান রাই।
আলি বলেন, তাদের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ওই দাঙ্গায় পুলিশের ভূমিকা কী ছিল তা নতুন করে খতিয়ে দেখা। জীবিতদের অভিযোগ ছিল ওই সহিংসতা শুরু করেছিল প্রভিন্সিয়াল আমর্ড কন্সটাবুলারি (পিএসি) নামে রাজ্যের একটি বিশেষ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। ওই পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়েছিল বিদ্রোহ এবং ধর্মীয় ও জাতিগত বিরোধের ঘটনাগুলো মোকাবেলার লক্ষ্য নিয়ে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল সহ নাগরিক স্বাধীনতা বিষয়ক সংস্থাগুলো মালিয়ানার ওই দাঙ্গা বিষয়ে যেসব তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছিল তাতে পিএসির জড়িত থাকার প্রমাণ তারা পেয়েছিল।
আলি আরো বলছেন যে “অন্তত ৩৬টি লাশের ময়নাতদন্তের যেসব রিপোর্ট আদালতে পেশ করা হয়েছিল তাতে তাদের শরীরে বুলেটের আঘাতের চিহ্ণ আছে”- এই ঘটনা যে সময়কার, তখন ওই গ্রামবাসীদের কারোর কাছেই বন্দুক ছিল না।
মালিয়ানার দাঙ্গায় পিএসি-র সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে বাহিনীর প্রতিক্রিয়া জানতে বিবিসি পিএসির সাথে যোগাযোগ করলে বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন তিনি “ওই ঘটনার বিষয়ে কথা বলার জন্য যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন”। বাহিনীর প্রধানের কাছে প্রতিক্রিয়ার জন্য ইমেলও পাঠানো হয়।
অভিযোগের তীর পুলিশের দিকে
হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ যেসব অভিযোগ নথিভুক্ত করে তাতে শুধু ৯৩ জন স্থানীয় হিন্দুর নাম ছিল অভিযুক্ত হিসাবে– এদের মধ্যে ২৩ জন মামলা চলাকালীন সময়ে মারা গেছে এবং ৩১ জনের “খোঁজই পাওয়া যায়নি”।
মামলায় বিবাদী পক্ষের আইনজীবী ছোটে লাল বানসাল বিবিসিকে বলেন, বাদি পক্ষের মামলা টেকেনি কার কারণ প্রধান সাক্ষী বলেন যে তিনি “পুলিশের চাপের মুখে অভিযুক্তদের নাম দিয়েছিলেন” এবং “পুলিশ এমন চার ব্যক্তির নাম অভিযুক্তের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছিল, যারা ওই দাঙ্গার ৭৮ বছর আগেই মারা গেছে এবং এক ব্যক্তি ওই ঘটনার সময় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ছিল”।
“মালিয়ানার মুসলমান জনগোষ্ঠির ওপর যা ঘটেছে তা দুঃখজনক এবং খুবই নিন্দনীয়। কিন্তু আমার মক্কেলরাও তো অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত- ৩৬ বছর ধরে তাদের দোষী প্রমাণ করার জন্য তাদের মাথার ওপর মামলা ঝুলছে,” তিনি বলেন।
তিনি আরো যোগ করেন, “বাদী এবং বিবাদী দুই পক্ষই বারবার পুলিশ এবং পিএসি বাহিনীকে ওই গণহত্যার জন্য দায়ী করেছে, কিন্তু তাদের নাম কখনই অভিযুক্ত হিসাবে নথিভুক্ত হয়নি।”
আদালতে ওই দাঙ্গার যেসব ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে তা রয়েছে ২৬ পৃষ্ঠার রায়ে। যেমন, এক যুবক কিভাবে গলায় বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, এক বাবাকে কিভাবে তলোয়ার দিয়ে খণ্ডবিখণ্ড করা হয়েছে, পাঁচ বছরের এক শিশুকে কিভাবে আগুনে ছুড়ে ফেলা হয়েছে।
ফলে আদালতের রায় ওই দাঙ্গা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়াদের এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যদের হতবাক করেছে।
মুসলিমদের মধ্যে ‘হতাশার কালো ছায়া’
দুদুটো বুলেটের ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন ভাকিল আহমেদ সিদ্দিকি। তিনি বলেছেন “মালিয়ানার মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আদালতের রায়ে ক্ষোভ আর হতাশার কালো ছায়া নেমে এসেছে।”
“যারা মারা গেছেন এবং যারা হত্যা করেছে তাদের সবাইকে আমি চিনি,” তিনি আমাকে বলেন। তিনি বলেন ১৯৮৭র ২৩শে মে-র ওই নৃশংসতার কথা তিনি যখনই বলেন, তার চোখে পানি চলে আসে।
তিনি বলেন ঘটনার আগে কয়েকদিন ধরেই তাদের গ্রামের আশপাশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো হচ্ছিল এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছিল।
“মীরাট বহু বছর ধরেই একটা বারুদের স্তুপের ওপর বসেছিল। পরিস্থিতি যেকোন সময়েই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠার অপেক্ষায় ছিল। সেখানে দাঙ্গা আগেও হয়েছে। কিন্তু আমরা কখনো ভাবিনি যে আমাদের গ্রামে কোনোরকম সহিংসতা হবে। কিন্তু ঘটনার দিন তিনটি গাড়িতে করে পিএসি বাহিনীর সদস্যরা আসে এবং মুসলিম এলাকাগুলো ঘিরে ফেলে। বেরুনর সব পথ বন্ধ করে দেয়,” তিনি জানান।
“তাদের কেউ কেউ মুসলিমদের বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। অন্যরা হিন্দুদের বাড়ির ছাদে অবস্থান নেয়। এরপর চারদিক থেকে শুরু হয় বন্দুকের গুলিবর্ষণ,” বলেন ভাকিল আহমেদ সিদ্দিকি।
‘আমরা কোথায় ভুল করলাম!’
আদালতে সাক্ষী দিতে হাতে গোনা যে কয়জনকে ডাকা হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন সিদ্দিকি।
“আমি এক বছর ধরে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়েছি। আমি আদালতকে পিএসির ভূমিকার কথা বলেছি, অভিযুক্তদের এবং তাদের হাতে থাকা অস্ত্রশস্ত্রও সনাক্ত করেছি।”
আদালতের রায়ে, তিনি বলেন, “মালিয়ানার প্রত্যেকে হতাশ”।
“আমি মনে করি অপরাধীদের দোষ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল। আমাদের জানতে হবে আমরা কোথায় ভুল করলাম! মালিয়ানায় যখন আগুন জ্বলছিল, গোটা বিশ্ব তখন সেই আগুনের ধোঁয়া দেখেছে। আদালত কেন তা দেখতে পেল না?” সিদ্দিকির প্রশ্ন।
মোহম্মদ ইসমাইলের পরিবারের ১১জন সদস্য ওই মুসলিম নিধনযজ্ঞে প্রাণ হারিয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন তার বাপমা, নানা, তার ছোট সাত ভাইবোন এবং একজন কাজিন। সবচেয়ে বয়স্ক ছিলেন তারা নানা- তার বয়স ছিল প্রায় ৮৫। সবেচয়ে কম বয়স ছিল তার ছোট বোনের- সে তখন কোলের শিশু। তিনি গ্রামের বাইরে ছিলেন বলে প্রাণে বেঁচে যান।
এই হত্যা যজ্ঞের খবর তার কাছে পৌঁছয় একদিন পর। কিন্তু তিনি নিজের গ্রামে ঢুকতে পেরেছিলেন “চার-পাঁচ দিন পর কারণ মীরাটে ঢোকার সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং জারি করা হয় কারফিউ”।
গ্রামে ঢোকার পর তিনি যা দেখেছিলেন তা ভাবলে এখনো তিনি শিউরে ওঠেন- তিনি বলছিলেন।
“আমাদের বাসা আগুনে পুড়ে গেছে, দেওয়াল জুড়ে ছিটানো রক্তের দাগ। আমাদের মুসলিম কিছু প্রতিবেশি যারা প্রাণে বেঁচেছিলেন তারা কাছেই এক মাদরাসায় পালিয়ে গেছেন।”
মোহাম্মদ ইসমাইল বলছেন, যদিও মীরাটের অন্যান্য জায়গা থেকে দাঙ্গার খবর আসছিল, কিন্তু তার পরিবার কখনো ভাবেনি তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হবে। “কারো সাথে আমাদের শত্রুতা ছিল না, কাজেই আমাদের কখনো দুশ্চিন্তা হয়নি।”
‘মুসলিমরা নিশানা’
সাংবাদিক আলি আমাকে জানান তিনি যখন ওই গণহত্যার দুদিন পর গ্রামে ঢোকেন খবর সংগ্রহ করতে তিনি একটা জায়গা দেখেন যেটি একটা “ধ্বংসস্তুপ…সব শুনশান, ভূতুড়ে”।
“বেশিরভাগ মুসলমান বাসিন্দা হয় মৃত, নয় বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, নয় তারা পলাতক।”
গ্রীষ্ম মৌসুমে ওই সহিংসতার ঘটনা, তিনি জানান, কোনো বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা ছিল না।
মীরাটে এই হত্যা যজ্ঞের কয়েক সপ্তাহ আগে ১৪ই এপ্রিল এক ধর্মীয় মিছিলের সময় দাঙ্গা বাঁধলে তার থেকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা শুরু হয়।
হিন্দু এবং মুসলিম দুই সম্প্রদায় মিলিয়ে জনা বারো মানুষ প্রাণ হারায়। কারফিউ জারি হয়। কিন্তু উত্তেজনা কমেনি। পরের বেশ কয়েক সপ্তাহে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জায়গায় দাঙ্গা হয়েছে।
সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা ১৭৪। কিন্তু বেসরকারি খবরে বলা হয় দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে ৩৫০ জনের বেশি এবং কোটি কোটি রুপি জানমালের ক্ষতি হয়েছে।
রাই বলছেন, “প্রথম দিকে দু পক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু পরের দিকে এটা মুসলমানদের নিশানা করে পুলিশ এবং পিএসি বাহিনীর সংঘবদ্ধ আক্রমণে পরিণত হয়।”
হাশিমপুরা হত্যা-যজ্ঞ
মালিয়ানা হত্যাকাণ্ডের একদিন আগে ২২ মে, পিএসি বাহিনীর সদস্যরা কাছেই মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হাশিমপুরায় চড়াও হয়।
তারা সেখান থেকে ৪৮ জনকে তুলে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে ৪২ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং তাদের লাশ একটা নদী আর একটা খালে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়। ছয় জন প্রাণে বেঁচে যায়, যাদের মুখ থেকে ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিবরণ জানা যায়।
আলোকচিত্র সাংবাদিক প্রাভিন জাইন যাকে পেটানো হয় এবং পুলিশ সেখান থেকে চলে যেতে বলে, তিনি একটি ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে তিনি মুসলিম পুরুষদের ওপর নির্যাতনের ছবি তোলেন। তাদের রাস্তা দিয়ে মিছিল করে নিয়ে যাওয়ার ছবিও তিনি তোলেন।
“আমি যখন সেখান থেকে চলে যাই, আমি জানতাম না তাদের হত্যা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,” তিনি বিবিসিকে বলেন।
দিল্লি হাই কোর্ট ২০১৮ সালে হাশিমপুরা থেকে মুসলিমদের অপহরণ ও হত্যার দায়ে পিএসি-র ২৬জন সাবেক সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
উত্তর প্রদেশের রাজধানী লখনৌর একজন ঊর্ধ্বতন সাংবাদিক শরত প্রধানের মনে আছে পিএসির বিরুদ্ধে “সাম্প্রদায়িক ও মুসলমান-বিরোধী” বলে ব্যাপক সমালোচনা ওঠার কথা।
“পিএসির বেশিরভাগ সদস্যই ছিল হিন্দু। সেনাবাহিনীতে যেমন ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তেমন কোন প্রশিক্ষণ তাদের কখনই দেয়া হয়নি।”
প্রধান বলেন, হাশিমপুরা হত্যা যজ্ঞের ঘটনায় ন্যায়বিচার যে হয়েছিল তার পেছনে ছিল মূলত রাই-এর প্রয়াস। ১৯৮৭ সালে তিনি ছিলেন গাজিয়াবাদের পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট। নিহতদের লাশ এবং একজন জীবিতকে তখন উদ্ধার করা হয়েছিল গাজিয়াবাদ থেকে।
আলি বলছেন মালিয়ানা হত্যাকাণ্ডেরও কোনো একদিন ন্যায়বিচার হবে বলে তিনি আশাবাদী।
“আমরা এই রায়কে হাই কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানাব। আমরা হাল ছাড়ব না,” তিনি আমাকে বলেন। “এই মামলায় ন্যায়বিচার যে বিলম্বিত হয়েছে তাই নয়, ন্যায়বিচার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।” সূত্র : বিবিসি